১৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগের অপেক্ষা: বিধিমালার অদৃশ্য জালে আটকা লাখো বেকারের স্বপ্ন
Primary Teacher Recruitment 2025: 17,000 Posts Stuck in Regulatory Tangle
বাংলাদেশের লাখো শিক্ষিত তরুণের কাছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি একটি পরম আকাঙ্ক্ষার নাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে যখন প্রায় ৯ লাখ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার কাজের সন্ধানে ঘুরছেন, তখন প্রায় ১৭ হাজার পদে শিক্ষক নিয়োগের একটি বিজ্ঞপ্তি তাদের জন্য ছিল বহু প্রতীক্ষিত এক আশার আলো। কিন্তু সেই আশায় গুঁড়েবালি। ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’ নামের নতুন এক বিধিমালার ত্রুটির কারণে এই বিশাল নিয়োগ প্রক্রিয়ার শুরুতেই তৈরি হয়েছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত জট।
Key Takeaways (গুরুত্বপূর্ণ তথ্য একনজরে)
- নিয়োগ স্থগিত: প্রায় ১৭,০০০ সহকারী শিক্ষক পদের জন্য কাঙ্ক্ষিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নতুন বিধিমালার ত্রুটির কারণে আটকে আছে।
- মূল কারণ: গত ২৮ আগস্ট জারি করা ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়ায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারছে না প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)।
- মানবিক সংকট: বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৯ লাখ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার রয়েছেন। এই বিলম্ব তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে যাদের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হতে চলেছে।
- দ্বিমুখী ক্ষতি: একদিকে শিক্ষক সংকটে ভুগছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো, অন্যদিকে চাকরির অভাবে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার যোগ্য প্রার্থী।
New Rules, New Crisis: Where is the Recruitment Stuck?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৮ আগস্ট নতুন শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা জারি করার পর ৩১ আগস্ট একটি কেন্দ্রীয় নিয়োগ কমিটিও গঠন করে। সবকিছু দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, সেই নতুন বিধিমালাই এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিধিমালাটির বিভিন্ন ধারায় কিছু ত্রুটি এবং অস্পষ্টতা ধরা পড়েছে, যা সংশোধন না করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে।
এই বিধিমালা সংশোধনের ফাইল এখন মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের মধ্যে চালাচালি হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘বিধির জালেই আটকা পড়েছে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদের নিয়োগ।’ এই প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতার প্রতিটি দিনই চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য একেকটি দীর্ঘশ্বাস হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ
এই পরিস্থিতিকে কেবল একটি প্রশাসনিক বিলম্ব হিসেবে দেখলে চলবে না। এটি একটি ভয়াবহ দ্বিমুখী সংকটের প্রতিচ্ছবি। একদিকে, দেশজুড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে হাজার হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার মানের উপর। অন্যদিকে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রি অর্জন করা লাখো তরুণ-তরুণী একটি চাকরির জন্য হাহাকার করছেন। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিলম্ব একযোগে দুটি সংকটকেই আরও গভীর করে তুলছে। এটি প্রমাণ করে, নীতি নির্ধারণ এবং তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কতটা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে।
The Sighs Hidden Behind the Numbers
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য আমাদের এক উদ্বেগজনক চিত্র দেখায়। ২০১৭ সালে যেখানে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় চার লাখ, মাত্র আট বছরের ব্যবধানে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে এখন প্রায় ৯ লাখে দাঁড়িয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো নিছকই সংখ্যা নয়; এর আড়ালে লুকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ পরিবারের স্বপ্ন, হতাশা আর সামাজিক চাপের গল্প।
খোরশেদ আলমের মতো হাজারো তরুণের গল্প এই পরিসংখ্যানকে জীবন্ত করে তোলে। তিনি বলেন, ‘আমার সরকারি চাকরির বয়স আর মাত্র তিন মাস বাকি। যদি এই বিজ্ঞপ্তি দ্রুত প্রকাশ না হয়, তাহলে আমার সরকারি চাকরি করার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।’ খোরশেদের মতো এমন অসংখ্য প্রার্থী প্রতিদিন বয়স হারানোর উদ্বেগে প্রহর গুনছেন। এই বিলম্ব তাদের মেধা বা যোগ্যতার অবমূল্যায়নই শুধু করছে না, তাদের ভবিষ্যৎকেও ঠেলে দিচ্ছে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে।
What’s in the New Recruitment Rules? (Quota vs. Merit)
আলোচিত ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫’-এ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো নারীদের জন্য পূর্বনির্ধারিত বিশেষ কোটা বাতিল করা।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদের ৯৩ শতাংশই পূরণ করা হবে মেধার ভিত্তিতে। বাকি ৭ শতাংশ পদ কোটার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই পদগুলোও মেধা তালিকা থেকেই পূরণ করা হবে, যা মেধাভিত্তিক নিয়োগকে উৎসাহিত করার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
- বেকারত্বের হার: দেশে প্রায় ৯ লাখ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো – বিবিএস)।
- প্রজ্ঞাপন জারি: নতুন নিয়োগ বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি হয় ২৮ আগস্ট, ২০২৫ (সূত্র: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)।
- কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: “নতুন বিধিমালায় বেশ কিছু ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে…চূড়ান্ত বিধি হাতে পেলেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।” – আবু নূর মো. শামসুজ্জামান, মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
Assurance from the Authorities and the Wait for a Solution
এই অচলাবস্থা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান আশ্বাস দিয়েছেন যে, তারা দ্রুত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে আন্তরিক। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দ্রুত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে। কিন্তু নতুন বিধিমালায় বেশ কিছু ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো সংশোধনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। চূড়ান্ত বিধি হাতে পেলেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।’
কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্য আশ্বস্ত করার মতো হলেও, চাকরিপ্রার্থীদের কাছে এখন প্রতিটি দিনই মূল্যবান। তারা আশা করছেন, মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই বিধিমালা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করবে এবং স্বচ্ছ পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একদিকে যেমন প্রাথমিক শিক্ষার সংকট দূর করবে, অন্যদিকে লাখো বেকারের মুখে হাসি ফোটাবে।
আরও পড়ুন: ইউটিউব এখন শপিং মল: ভিডিও দেখার পাশাপাশি আসছে কেনাকাটার ৪টি নতুন সুবিধা